গ্যাস্ট্রিক আলসার কি ?
গ্যাস্ট্রিক আলসার মূলত পরিপাকতন্ত্রের একটি রোগ। পরিপাকতন্ত্রে এসিডের আধিক্য ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারনে এ রোগ হয়ে থাকে। সাধারণত পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্ত্রের ভেতরের দেয়ালে ক্ষত সৃষ্টির মাধ্যমে এ রোগের প্রকাশ পায়। সাধারণ মানুষ গ্যাস্ট্রিক আলসার বলতে যেটা বুঝে সেটা আসলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘পেপটিক আলসার’। সাধারণত মানুষ মনে করে থাকে যে অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া, পাকস্থলীতে এসিডের আধিক্য, পাকস্থলীর HCl এসিডের কারনে এ রোগ হয়। কিন্তু এ রোগের অন্যতম কারন Helicobacter pylori নামের এক ব্যাকটেরিয়া |
গ্যাস্ট্রিক আলসার রোগের জীবাণু
এতোদিন আলসারের প্রকৃত কারন পাকস্থলীর অম্লীয় পরিবেশ ও HCl এসিডকে বিবেচনা করা হলেও পরবর্তীতে জানা যায় যে, হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামক ব্যাকটেরিয়ার কারনেই মূলত এ রোগ হয়ে থাকে। পূর্বে এই ব্যাকটেরিয়ার নাম ছিলো ক্যাম্পাইলোব্যাক্টার পাইলেরি (Campylobacter pylori)। এটি একটি গ্রাম নেগেটিভ স্পাইরাল ব্যাকটেরিয়া। এটি দেখতে অনেকটা পেঁচানো আকৃতির এবং এই আকৃতির কারনেই এরা পাকস্থলীর প্রাচীরে সহজে প্রবেশ করতে পারে এবং ইনফেকশন ঘটাতে পারে। এসব ব্যাকটেরিয়া মূলত অম্লীয় পরিবেশে জন্ম নেয়। ১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার বেরি মার্শাল ও রবিন ওয়ারেন এই ব্যাকটেরিয়া প্রথম আবিষ্কার করেন।
গ্যাস্ট্রিক আলসার কেন হয়?
আলসার বেশ কয়েকভাবেই হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম কারন হলো জীবাণুর দ্বারা আক্রমণ। কিন্তু এই জীবাণু এমনি এমনি মানুষকে আক্রমণ করে না। গবেষণায় দেখা গেছে যে এ রোগের জীবাণু Helicobacter pylori আগে থেকেই মানুষের পরিপাকতন্ত্রে অবস্হান করে। এই ব্যাকটেরিয়া সাধারণত অম্লীয় পরিবেশে বেশি জন্মায় এবং এরা অম্লীয় বা এসিডিক পরিবেশ পছন্দ করে। মানুষের অনিয়মিত খাওয়াদাওয়া ও দীর্ঘক্ষণ পেট খালি রাখার কারনে পাকস্থলীতে HCl এসিড এসে জমে থাকে এবং পাকস্থলী ও খাদ্যনালীতে অম্লীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ অম্লীয় পরিবেশ হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি এর জন্য আদর্শ বিধায় এরা খুব সহজেই বংশবৃদ্ধি করতে থাকে।
এ রোগ হওয়ার বেশ কয়েকটি কারন নিচে উল্লেখ করা হলো :-
- জীবাণুর আক্রমণ : হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামক জীবাণুর আক্রমণের মাধ্যমেই প্রধানত এই রোগ হয়ে থাকে।
- বংশগত : এ রোগটি বংশগত ভাবেও হতে পারে। পূর্বপুরুষদের মধ্যে এ রোগ থাকলে উত্তরসূরিদের মাঝেও এ রোগ আসতে পারে।
- অনিয়মিত আহার : অনিয়মিত আহারের ফলে পাকস্থলীতে এসিডিটি বৃদ্ধি পায় যা জীবানুর জন্য আদর্শ পরিবেশ।
- ধূমপান : ধূমপায়ীদের মধ্যে এ রোগ হওয়ার প্রবণতা অত্যন্ত বেশি।
- ওষুধ : দীর্ঘদিন ব্যথানাশক ও স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবনেও এ রোগ হতে পারে।
- পূর্বে ধারনা করা হতো যে ভাজা পোড়া বেশি খেলে এ রোগ হয়, যার কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মেলেনি।
আরও পড়ুন : পাইলস থেকে চিরতরে মুক্তির উপায়
গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ
- বুকজ্বালা করা।
- পেটের উপরের দিকে যন্ত্রণা হওয়া।
- খাওয়ার পর পেট ফেঁপে থাকা।
- পেটের ব্যথায় অনেক সময় মনে হবে পেট পুড়ে যাচ্ছে।
- শুধুমাত্র এন্টাসিড খেলেই পেটের ব্যথা কমে।
- খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পেট ব্যথা শুরু হয়।
- পেটের ব্যথা অনেক সময় বাড়তে বাড়তে ঘাড় পর্যন্ত চলে আসতে পারে।
- পিঠের দিকেও ব্যথা ছড়াতে পারে।
- বমি বমি ভাব হয় এবং বমি হয়।
- মলত্যাগের সময় রক্তপাত হতে পারে কিংবা কালো মলত্যাগ হতে পারে।
- বেশি বেশি ঢেকুর উঠা ও আলসারের লক্ষণ।
- অবসাদগ্রস্ত থাকা।
আরও পড়ুন : দ্রুত বীর্যপাতের কারন, চিকিৎসা ও ঔষধ
গ্যাস্ট্রিক আলসারের পরীক্ষা
রোগীর কাছ থেকে সমস্ত তথ্য জানার পর ডাক্তাররা সাধারণত সিদ্ধান্ত নেন তিনি কোন উপায়ে আলসারের টেস্ট করাবেন। যদি আলসার প্রাথমিক অবস্থায় থাকে তাহলে ডাক্তাররা জটিল টেস্ট না করে সহজ টেস্টের মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। এক্ষেত্রে সহজ টেস্টের মধ্যে কয়েকটি হলো ইউরিয়া ব্রেথ টেস্ট, স্টুল এন্টিজেন টেস্ট ও হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি এন্টিবডি টেস্ট।
ইউরিয়া ব্রেথ টেস্টের মাধ্যমে রোগীকে এক ধরনের পানীয় পান করানো হয়। ওই পানীয় পেটে যাওয়ার পর আলসারের ব্যাকটেরিয়া এক ধরনের বিশেষ রাসায়নিক তৈরি করে। রোগীর নিঃশ্বাসের সাথে ওই বিশেষ রাসায়নিকটি পাওয়া গেলে বুঝতে হবে যে পাকস্থলীতে হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি রয়েছে। আর ওই রাসায়নিক না পাওয়া গেলে বুঝতে হবে যে পাকস্থলীতে ব্যাকটেরিয়াটি নেই। এক্ষেত্রে অন্য কোনো মাধ্যমে আলসার হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
স্টুল এন্টিজেন টেস্টের মাধ্যমে রোগীর স্টুল বা মল পরীক্ষা করা হয়। যেহেতু হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি আমাদের পরিপাকতন্ত্রে থাকে, সেহেতু এরা মলের সাথেও বাইরে বেরিয়ে আসে। এ মল / পায়খানা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়। এতে হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরির উপস্হিতি শণাক্ত করা গেলে বুঝতে হবে এর মাধ্যমেই আলসার হয়েছে।
হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি এন্টিবডি টেস্টটি মূলত রক্তের মাধ্যমে করা হয়। আমাদের শরীরে কোনো জীবাণু প্রবেশ করলে রক্তের শ্বেত রক্তকণিকা ওই জীবাণুর বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরী করে। এই এন্টিবডি ওই জীবাণুটিকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে। প্রত্যেক ধরনের জীবানুর জন্য আলাদা আলাদা এন্টিবডি উৎপন্ন হয়। তেমনি হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি এর এন্টিবডি ও অন্যান্য জীবাণুর এন্টিবডির চেয়ে আলাদা। রক্ত পরীক্ষা করে হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি প্রতিরোধী এন্টিবডি পাওয়া গেলে বুঝতে হবে আলসার এ জীবাণুর মাধ্যমেই হয়েছে।
উপরিউক্ত ৩ টি উপায়ে ডাক্তার শিউর হয়ে নেন যে পাকস্থলীর আলসার মূলত কিসের কারনে হয়েছে এবং সে অনুযায়ী ঔষুধের পরামর্শ দেন।
উপরে উল্লিখিত ৩ টি উপায়ে কোনো ফলাফল পাওয়া না গেলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তখন এন্ডোসকপি করার পরামর্শ দেন। এ পদ্ধতিতে একটি পাতলা, সরু ও নমনীয় নল গলার ভিতর দিয়ে প্রবেশ করানো হয় একদম ক্ষুদ্রান্ত্র পর্যন্ত। তারপর ওই নলে থাকা ক্যামেরার সাহায্যে পেটের ভিতরের ছবি দেখা যায় এবং ছবি দেখে আলসারের কারন, প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
কখনো কখনো আলসারের অবস্থাভেদে পরিপাকতন্ত্র থেকে টিস্যু ও সংগ্রহ করা হয় হিস্টোপ্যাথোলজির মাধ্যমে টেস্ট করানোর জন্য।
আরও পড়ুন : টাইফয়েড জ্বর ভালো করার উপায়!
গ্যাস্ট্রিক আলসারের চিকিৎসা
বর্তমানের উন্নত মেডিকেল সায়েন্সের যুগে কোনো কিছুই অসাধ্য নয়। তেমনি গ্যাস্ট্রিক আলসারের জন্যও রয়েছে অনেক উন্নত চিকিৎসা। সঠিক ভাবে চিকিৎসা করলে কয়েক মাসের মধ্যই এ রোগ থেকে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করা যায়।
এ রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে মূলত কোন কারনে এ রোগটি হয়েছে। যদি হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে এ রোগ হয়ে থাকে তাহলে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। রোগী যদি NSAID জাতীয় ওষুধ সেবন করে থাকে তাহলে এসব ওষুধ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে কিংবা কমিয়ে এ রোগের উন্নতি ঘটানো সম্ভব। তবে এটা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিবেন। গ্যাস্ট্রিক আলসারের কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি নিম্নরূপ :-
এন্টিবায়োটিক
যদি আপনার পরিপাকতন্ত্রে হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি শণাক্ত করা যায় তাহলে ডাক্তার সাধারণত এন্টিবায়োটিক সাজেশন করেন। এন্টিবায়োটিক শরীরের হেলিকোব্যাক্টার ব্যাক্টেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এক্ষেত্রে কিছু কার্যকরী এন্টিবায়োটিক গুলো হলো :-
- অ্যামোক্সিসিলিন,
- ক্ল্যারিথ্রোমাইসিন,
- মেট্রোনিডাজোল,
- টিনিডাজোল,
- টেট্রাসাইক্লিন,
- লেভোফ্লোক্সাসিন।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নির্ধারণ করবেন আপনি কোন এন্টিবায়োটিক সেবন করবেন। ডাক্তার এন্টিবায়োটিকের কোর্স দিলে অবশ্যই আপনাকে এন্টিবায়োটিক এর কোর্স শেষ করতে হবে। মাঝপথে এন্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করে দেওয়া উচিত হয়। সাধারণত ২ সপ্তাহের এন্টিবায়োটিকের কোর্স দেওয়া হয়। এন্টিবায়োটিকের সাথে কিছু আলাদা ওষুধ ও দেওয়া হতে পারে।
প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর বা পিপিআই (PPI)
প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর হলো এক ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্হা যার মাধ্যমে পাকস্থলীর HCl এসিড উৎপাদন কমিয়ে দেয়া হয়। এসিড কমে গেলে আলসারের ঘা দ্রুত সেরে উঠে। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত ওষুধ গুলো হলো :
- ওমিপ্রাজল
- ল্যানসোপ্রাজল
- ইসোমিপ্রাজল
- প্যানটোপ্রাজল
- রাবেপ্রাজল
দীর্ঘদিন যাবত প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর জাতীয় ওষুধ সেবন করলে শরীরের হাড় ভঙ্গুর হয়ে যেতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়াম ওষুধ খেলে এ শঙ্কা থেকে মুক্ত থাকা যাবে।
H2 ব্লকার
হিস্টামিন ব্লকার বা H2 ব্লকার ওষুধগুলো ও পাকস্থলীর হাইড্রোক্লোরিক এসিড উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এ জাতীয় ওষুধগুলো হলো :
- ফ্যামোটিডিন
- সিমেটিডিন
- নিজাটিডিন
এন্টাসিড ও সাইটোপ্রোটেকটিভ এজেন্ট
আলসারের চিকিৎসায় ডাক্তাররা সাধারণত এন্টাসিড জাতীয় ওষুধেরও পরামর্শ করে থাকেন। এন্টাসিড জাতীয় ওষুধ পাকস্থলীর হাইড্রোক্লোরিক এসিডকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। তবে এন্টাসিড জাতীয় ওষুধের ব্যবহারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে ডায়রিয়া হতে পারে। এন্টাসিড সাধারণত আলসারের তাৎক্ষনিক ব্যথা নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। এ রোগের চিকিৎসায় এন্টাসিডের ভূমিকা নেই।
সাইটোপ্রোটেকটিভ এজেন্ট জাতীয় ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয় সাধারণত পাকস্থলী ও অন্ত্রের ভিতরের আবরণ রক্ষা করার জন্য। ভিতরের আবরণের টিস্যুগুলোর যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেজন্য এসব ওষুধ সেবন করা হয়। এ জাতীয় ওষুধগুলো হলো :
- সাক্রালফেট
- মিসোপ্রোস্টোল
বি. দ্র. উপরে বর্ণিত চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো শুধু বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই নির্বাচন করবেন। নিজে নিজে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে সেবন করা মোটেও কাম্য নয়। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে এবং মৃত্যুঝুঁকিও থাকে।
আরও পড়ুন : ইরেকটাইল ডিসফাংশন এর চিকিৎসা
আলসার হলে করণীয়
পরিপাকতন্ত্রের আলসার মারণ রোগ বা প্রাণঘাতী হতে পারে। এই রোগের ফলে খাদ্যনালী, পাকস্থলী বা অন্ত্রে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং সে ক্ষত হতে রক্ত ঝরতে থাকে। এ রক্ত মলের সাথে মিশে গিয়ে কালো রং ধারণ করে। এজন্যই মলত্যাগের সময় আলকাতরার মতো কালো মল বেরিয়ে আসে। এ রোগ হলে প্রথমেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। দীর্ঘদিন এ রোগের চিকিৎসা না করলে ক্ষত গুলো বড় হতে হতে শেষে খাদ্যনালী বা পাকস্থলী ফুটো হয়ে যায় এবং এ ফুটো দিয়ে খাদ্য বেরিয়ে যায়। তখন খুবই জটিল পরিস্হিতির সম্মুখীন হতে হয়। মনে রাখতে হবে আলসার মানেই ক্যানসার নয়, তবে সঠিক চিকিৎসা করানো না হলে এ রোগ ক্যানসারে রূপ নিতে পারে। এই রোগ হলে যা যা করতে হবে তা হলো :
- ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্হা নিতে হবে।
- পরিপাকতন্ত্রে এসিডের মাত্রা কমিয়ে রাখতে হবে।
- খালি পেটে দীর্ঘক্ষণ থাকা যাবে না।
- সঠিক পদ্ধতিতে আহার ও পানি পান করতে হবে।
- সাময়িক স্বস্তির জন্য এন্টাসিড বা গ্যাসের ওষুধ খেয়ে রোগ বাড়াবেন না।
গ্যাস্ট্রিক আলসারের জটিলতা
গ্যাস্ট্রিক আলসার বা পাকস্থলীর আলসারের শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করলে এ রোগ সেরে যায়। কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী না চললে গ্যাস্ট্রিক আলসার, রিফ্রেক্টরি আলসারে রূপ নেয়। রিফ্রেক্টরি আলসারের সাধারণত আর কোনো চিকিৎসার উপায় থাকে না। কিছু কিছু কারনে আলসারের এ জটিলতা দেখা দেয়। কারনগুলো হলো :
- ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন না করলে।
- হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি ব্যাকটেরিয়াটি যদি এন্টিবায়োটিক রেজিট্যান্ট হয়।
- NSAID জাতীয় ওষুধের নিয়মিত ব্যবহার।
- নিয়মিত ধূমপান।
রিফ্রেক্টরি আলসারের কারনে শরীরে যেসব জটিলতা দেখা দেয় :
- পাকস্থলীতে অতিরিক্ত এসিড উৎপাদন হয়।
- জলিঙ্গার-এলিসন সিনড্রোম দেখা দেয়।
- পাকস্থলীর ক্যান্সার দেখা দেয়।
- ক্রোন’স ডিজিস হতে পারে।
- পাকস্থলীর ভেতরের আবরণে ক্ষত হতে হতে একসময় ফুটো হয়ে যেতে পারে।
- পরিপাকনালীর ভেতর দিয়ে খাবার চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
- অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হতে পারে।
- অনেকদিন ধরে অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হলে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে।
তবে এসব জটিলতা দেখা দিলে ভয় পাওয়ার কোনো কারন নেই। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে ডাক্তারের পরামর্শে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা করাতে হবে।
গ্যাস্ট্রিক আলসার রোগীর খাদ্য তালিকা
এটি যেহেতু একটি পরিপাকতন্ত্রের রোগ তাই এ রোগে আক্রান্ত রোগীর খাদ্যতালিকা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট খাবার বাদে রোগী মোটামুটি সবধরনের খাবার ই খেতে পারবেন। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যে সকল খাবার পরামর্শ দিবেন তা খেলে এ রোগের ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যাবে। নিম্নে আলসার রোগীদের জন্য কিছু খাদ্যের তালিকা দেওয়া হলো যা সাধারণত ডাক্তাররা পরামর্শ দিয়ে থাকেন :
১। মধু : মধু একটি ন্যাচারাল এন্টিসেপটিক হওয়ায় মধু খেলে আলসারের ঘা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
২। টক দই : টক দইয়ে শরীরের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়ায় থাকে যাদের প্রোবায়োটিক বলা হয়। এ ব্যাকটেরিয়া গুলো আলসারের ইনফেকশন সারাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৩। ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার : বিভিন্ন শাক ও সবজিতে প্রচুর ফাইবার থাকে। এরা পেটের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
৪। মিষ্টি আলু, পালংশাক : এগুলোতে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে। এ সকল খাদ্য আলসার নিরাময়ে সাহায্য করে।
৫। চর্বিহীন মাংস : প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে রোগী চর্বিহীন মাংস বা কম চর্বিযুক্ত মাংস বিশেষ করে পোলট্রি মাংস খেতে পারেন।
৬। ফুলকপি, বাধাকপি, ব্রকোলি : আলসার রোগীর জন্য এ খাবার গুলো অত্যন্ত উপকারী। এগুলোর মধ্যে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ ও ফাইবার রয়েছে।
৭। নাশপাতি, আপেল, স্ট্রবেরী : ফলের মধ্যে এ ফলগুলো রোগীর জন্য অত্যন্ত উপকারী। এ ফলগুলোতে এন্টি অক্সিডেন্ট ও ফাইবার রয়েছে।
৮। ক্যাপসিকাম, গাজর : ক্যাপসিকামে রয়েছে ভিটামিন ‘সি’ এবং গাজরে রয়েছে ভিটামিন ‘এ’ যা রোগীর জন্য অত্যন্ত উপকারী।
আলসার হলে কি কি খাওয়া যাবে না
এ রোগের রোগীদেরকে ডাক্তার সাধারণত নিম্নোক্ত খাবারগুলো খেতে নিষেধ করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগী এসব খাবার খেতে পারেন তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে।
১। দুধ : পূর্বে ধারণা করা হতো দুধ খেলে আলসার ভালো হয় যা শতভাগ ভ্রান্ত ধারণা। উল্টো দুধ খেলে পাকস্থলীতে এসিডের পরিমাণ বেড়ে যায় যা রোগীর জন্য ক্ষতিকর।
২। ভাজা পোড়া ও চর্বিযুক্ত খাবার : ভাজা পোড়া ও চর্বিযুক্ত খাবারের কারনে এ রোগ না হলেও, এ রোগ হওয়ার পর কিন্তু অবশ্যই ভাজা পোড়া ও চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। এসকল খাবার পাকস্থলী ও অন্ত্রের ঘা কে আরও বাড়িয়ে দেয়।
৩। এলকোহল : রোগী এলকোহল কিংবা মদ্যপানে আসক্ত থাকলে জরুরি ভিত্তিতে এটি পরিহার করতে হবে।
৪। নিকোটিন ও মাদক : রোগী ধূমপায়ী হলে অতিসত্বর ধূমপান ত্যাগ করতে হবে। রোগী মাদকাসক্ত হলে মাদক ত্যাগ করতে হবে।
৫। কফি : রোগী কফি খাবে কি খাবে না এটা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন।
৬। অত্যধিক ঝালযুক্ত খাবার : অত্যধিক ঝালযুক্ত খাবার রোগীর আলসারের ঘা এর যন্ত্রণা বাড়িয়ে তুলবে।
৭। গরম খাবার ও গরম পানি : চেষ্টা করুন রোগীকে ঠান্ডা খাবার ও ঠান্ডা পানি খাওয়াতে। গরম খাবার রোগীর যন্ত্রণা বাড়িয়ে তুলবে। সর্দি কাশির সমস্যা না থাকলে রোগীকে ঠান্ডা পানি খাওয়ান। এতে যন্ত্রণা কমবে। তবে অত্যধিক ঠান্ডা পানি খাওয়াবেন না।
৮। লেবু, কমলা, বাতাবিলেবু : এসকল ফল পরিমিত পরিমানে খেতে পারবেন তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী। এসকল ফল অত্যধিক খাওয়া যাবে না।
৯। চকলেট, আইসক্রিম : ডাক্তার নির্ধারণ করবেন আপনি চকলেট ও আইসক্রিম খেতে পারবেন কিনা।
Frequently Asked Questions (FAQs)
প্রশ্ন. পেটের / পাকস্থলীর / ক্ষুদ্রান্ত্রের আলসার কেন হয় ?
উত্তর. পরিপাকতন্ত্রের আলসার মূলত হয় হেলিকোব্যাক্টার পাইলোরি নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে। অনিয়মিত খাবার দাবার, দীর্ঘদিন যাবত ব্যথানাশক ওষুধ সেবন কিংবা ধূমপান ও মদ্যপানে অভ্যস্ত থাকলে গ্যাস্ট্রিক আলসার হয়ে থাকে।
প্রশ্ন. পাকস্থলী অথবা ক্ষুদ্রান্ত্রে আলসার হলে কি করে বুঝবেন ?
উত্তর. সাধারণত গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণগুলো থেকে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। তার মধ্যে পেটে ব্যথা গ্যাস্ট্রিক আলসারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। গ্যাস্ট্রিক আলসারের লক্ষণ শুরু হয় পেট ব্যথার মাধ্যমেই। তাই যাদের ঘন ঘন পেট ব্যথার সমস্যা আছে তারা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে একটি এন্ডোসকপি টেস্ট করে নিবেন।
প্রশ্ন. গ্যাস্ট্রিক আলসার থেকে কি ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে ?
উত্তর. গ্যাস্ট্রিক আলসারকে সহজভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নাই কারন এটা প্রাণঘাতী হতে পারে। এছাড়া পরিপাকতন্ত্র ফুটো হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। তাই কোনো ভাবেই অবহেলা কাম্য নয়।
প্রশ্ন. গ্যাস্ট্রিক আলসার কাদের বেশি হয় ?
উত্তর. যারা দীর্ঘদিন যাবত অনিয়মিত খাবার খান, যারা খাবারে তেল মসলাযুক্ত খাবার বেশি খান, যারা ধূমপান ও মদ্যপান করেন, যারা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেন, যারা দীর্ঘদিন যাবত ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করেন।
প্রশ্ন. আলসার হলে কি লেবু খাওয়া যাবে ?
উত্তর. অনেকেই মনে করেন আলসার হলে লেবু একদমই খাওয়া যাবে না কারন এটি পেটে এসিডিটি বাড়ায়, যা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। পাকস্থলীতে এসিডিটি হয় মূলত HCl এসিডের কারনে যা অত্যন্ত শক্তিশালী এসিড। লেবুতে থাকে সাইট্রিক এসিড যা একটি জৈব এসিড এবং অত্যন্ত দুর্বল একটি এসিড। এই এসিড আমাদের শরীরের জন্য উপকারী কারন এই এসিড আমাদের শরীরে ভিটামিন সি সরবরাহ করে। তাই প্রয়োজনীয় মাত্রায় আপনি লেবু খেতে পারবেন তবে অতিরিক্ত মাত্রায় নয়। লেবু খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।
প্রশ্ন. আলসার সাধারণত পরিপাকতন্ত্রের কোথায় হয় ?
উত্তর. আলসার সাধারণত পরিপাকতন্ত্রের পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্ত্রে হয়ে থাকে।
প্রশ্ন. আলসার কি প্রাণঘাতী ?
উত্তর. হ্যাঁ আলসার প্রাণঘাতী হতে পারে যদি একে অবহেলা করা হয়। আলসার থেকে ক্যান্সার সৃষ্টি হতে পারে।
প্রশ্ন. আলসার নির্ণয়ের পন্থা কি ?
উত্তর. এন্ডোসকপি হলো এ রোগ নির্ণয়ের অন্যতম পন্থা।
প্রশ্ন. কোন বয়সে এ রোগ বেশি দেখা যায় ?
উত্তর. যে কোনো বয়সেই গ্যাস্ট্রিক আলসার হতে পারে যদি তার মধ্যে গ্যাস্ট্রিক আলসার হওয়ার কারনগুলো থাকে। তবে বয়স্কদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যায়।
প্রশ্ন: ডিওডেনাল আলসার কি ?
উত্তর : ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম অংশে যে আলসার হয় সেটাই ডিওডেনাল আলসার।
প্রশ্ন: আলসার কি ভালো হয় ?
উত্তর: বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললে আলসার ভালো হয়।
প্রশ্ন: আলসারের ব্যথা কমানোর উপায় কি ?
উত্তর: তাৎক্ষণিক ব্যথা কমানোর উপায় হলো এন্টাসিড ওষুধ। তাছাড়া গরম খাবার পরিহার করা, ঠান্ডা পানি খাওয়া, দই খাওয়া, ঝাল, তেল ও মশলাযুক্ত ভাজা পোড়া খাবার পরিহার করা ইত্যাদি মেনে চললে আলসারের ব্যথা অনেকটাই কমে যায়।
Disclaimer : এ ওয়েবসাইটে দেওয়া সকল তথ্য শুধুমাত্র জানার জন্য। রোগীকে সরাসরি না দেখে এবং রোগীর পরীক্ষা না করে রোগ এবং রোগের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। তাই নিজে নিজে কোনো ওষুধ খাবেন না। অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।