পাইলস কী?
পাইলস আমাদের শরীরে হওয়া একটি গোপন, ক্ষতিকর এবং অন্যতম যন্ত্রনাদায়ক রোগ। আমাদের দেহের পায়ুপথ ফুলে সৃষ্টি হওয়া এক জটিল রোগ এই পাইলস। পাইলসের অন্য একটি নাম হলো অর্শ্বরোগ। আমাদের দেহেরে বৃহদান্ত্রের শেষাংশে রেকটাম নামের একটি বস্তু থাকে যার ভিতরে ও বাইরে দেখতে অনেকটা বালিশের মতো রক্তশিরার জালিকা থাকে। এগুলোর প্রসরনের ফলেই মূলত সৃষ্টি হয়।
পাইলস কীভাবে হয় ও হওয়ার কারন-
কীভাবে?
পাইলস হওয়ার এক্সাক্ট কারন বহু বছরের গবেষনার পরেও বের করা যায়নি। তবে কিছু নির্দিষ্ট কারন এবং অভ্যাসের ফলে এই রোগ মানুষের দেহে বাসা বাধতে সক্ষম হয়। এই রোগ মূলত ৩০-৬০ বছর বয়েসের মানুষের মধ্যেই বেশি লক্ষ্য করা যায়। খুবই অল্প কিছু ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র ৩০ বছরের নিচে কারো পাইলস হতে দেখা যায় এবং ২০ বছরের নিচে এই রোগ কারো হয়না বললেই চলে। পাইলস রোগটিতে আক্রান্ত রোগীদের উপর সার্ভে করে পাওয়া গিয়েছে যে, এই রোগ মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের-ই বেশি হয়। পাইলস আসলে কোনো বহিরাগত বস্তু দ্বারা সৃষ্টি হওয়া কোনো রোগ নয়, এটি মুলত নির্দিষ্ট কিছু অভ্যাস এবং কারনে হয়ে থাকে। একে এজমা, এপেনডিক্স এবং টনসিল এর সাথে তুলনা করা যায়। আমাদের কিছু ভূলের কারনে দেহের বিশেষ একটি সংবেদনশীল অংশ পরিবর্তন হয়ে আমাদের দেহে এই রোগটি সৃষ্টি হয়। আমাদের পায়ুপথে থাকা রেকটাম এর চারদিকে থাকা রক্তশিরা গুলো দেহের প্রয়োজনের সাপেক্ষে প্রসারিত এবং সংকুচিত হয়ে থাকে। কিন্তু, যখন সেখানে কোনো কারনে সংক্রমন হয় তখন এই শিরা গুলো মাত্রাতিরিক্ত্র প্রসারিত হয়ে যায় এবং এই শিরা গুলো ফুলে পাইলসের সৃষ্টি করে। এই অবস্থা-কে হেমারয়েডস বলে। এই ফুলা বেড়ে গেলে রক্তশিরায় অতিরিক্ত চাপের সৃষ্টি হয় এবং একসময় এই শিরা গুলো ফেটে গিয়ে রক্তপাত শুরু হয়। তাছাড়া রক্তক্ষরনের সাথে সাথে চুলকানি ও দেখা যায়। এর ফলে পায়ুপথের নিচের অংশ গোল হয়ে ফুলে যায় এবং মলত্যাগের সমন্য এবং সাধারন অবস্থায় ও পায়ুপথে রক্তক্ষরন হতে পারে। যা প্রচন্ড যন্ত্রনাদায়ক এবং অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি করে। তাছাড়া, যেসব মানুষ দীর্ঘকাল ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যের মতে রোগে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
আরও পড়ুন : ডায়াবেটিস রোগীর খাবার তালিকা এবং নিষিদ্ধ খাবারের তালিকা
কারনঃ
কারন ও অভ্যাসগুলো হলো
- অস্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন করা,
- যথেষ্ঠ পরিমানে পানি পান না করা,
- মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত প্রেসার দেয়া,
- দীর্ঘসময় টয়লেটে বসে থাকা,
- দীর্ঘসময় একসাস্থানে দারিয়ে থাকা,
- দীর্ঘদিন কোষ্ঠকাঠিন্য রোগে ভোগা,
- ভারী কাজ করা,
- আটসাট পোশাক পড়া,
- পায়ুপথে যৌন সঙ্গম,
- স্থুলতা,
- কায়িক শ্রম,
- লিভারের রোগ,
- গর্ভকালীর সময়ে,
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার কম বা না খাওয়া,
- হরমোনের প্রভাব,
- দীর্ঘদিন ধরে ডায়রিয়া রোগে ভোগা,
- বংশগত ধারা, ইত্যাদি।

পাইলসের কত প্রকার?
পাইলস সাধারনত দুই প্রকার হয়ে থাকে –
- অভ্যন্তরীন পাইলস
- বাহ্যিক পাইলস
পাইলসের এই প্রকারভেদ মূলত মলদ্বারের মুখ থেকে এদের অবস্থানের দূরত্বের উপর ভিত্তি করে করা হয়। পায়ুপথের মুখের ২-৪সে.মি. দূরত্বের মধ্যেই মূলত এদের অবস্থান হয়।
অভ্যন্তরীন পাইলস
1. প্রথম পর্যায়
পাইলসের অবস্থান ভিতরের দিকে হয় এবং মলদ্বারের ভিতরেই তা ফুলে অবস্থান করে। এটি বাইরে বের হয়ে এসে প্রলেপস গঠন করে না।
2. দ্বিতীয় পর্যায়
মলত্যাগের সময় এবং মূত্রত্যাগের সময় চাপ প্রয়োগের ফলে পাইলস বাইরে বের হয়ে যায়। তবে পরে তা নিজে থেকেই ঠিক হয়ে যায়।
3. তৃতীয় পর্যায়
এই পর্যায়ে রোগের মাত্রা বেড়ে যায়। তখন পাইলস বের হলে তা আর নিজে থেকে ঠিক হতে পারে না। তখন নিজে তা ঠিক করে নিতে হয় এবং এতে করে যন্ত্রনা আরো কয়েকগুন বেড়ে যায়।
4. চতুর্থ পর্যায়
পাইলস অতিরিক্ত পরিমানে ফুলে যায় এবং মলত্যাগ ছাড়াও সাধারন ভাবেই তা বাইরে বের হয়ে আসে। কিন্তু, এই পর্যায়ে তা আর নিজে থেকে ঠিক হয়না এমনকি নিজে ঠিক করেও দেয়া যায়না এবং তা বাইরেই থেকে যায়। যার ফল ঐ স্থানে প্রলেপস এর সৃষ্ঠি হয়। এই পর্যায়ে এসে গেলে দ্রুত হাসপাতালে যাওয়া এবং যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করা ছাড়া আর উপায় থাকে না।
আরও পড়ুন : জেনে নিন নিউমোনিয়ার লক্ষণ ও চিকিৎসা।
বাহ্যিক পাইলস
বাহ্যিক পাইলস পায়ুপথের বাইরে সৃষ্টি হয়। এতে করে পায়ুপথের বাইরের অংশে ছোট ছোট গোটার সৃষ্টি হয়। এগুলো প্রচুর চুলকানিদায়ক হয়ে থাকে। বাহ্যিক পাইলসের ক্ষেত্রে যন্ত্রনা অসহ্যকর হয় এবং কোথাও বসার সময় তা বেড়ে যায়।
পাইলসের লক্ষন
পাইলসের কিছু সাধারন লক্ষন রয়েছে যা অভ্যন্তরীন এবং বাহ্যিক উভয়ের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। তবে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীন পাইলসের মধ্যে লক্ষনের পার্থক্য দেখা যায়।
সাধারন লক্ষন
- পায়ুপথে ব্যাথা করে এবং পায়পথের মুখে চুলকানি হয়।
- মলত্যাগের সময় বা পরে রক্তক্ষরন হয়।
- মলদ্বারের চারপাশে একটি ফুলে থাকা শক্ত গোটা দেখা যায়।
বাহ্যিক পাইলসে লক্ষন
- পায়ুপথের চারপাশ প্রচন্ড চুলকায়।
- পায়ুপথের মুখ বা পাশের অংশ ফুলে যায় এবং ভিষন ব্যাথা অনুভুত হয়।
- কোথাও বসতে গেলে ব্যাথা করে।
- পায়ুপথে রক্তক্ষরন হয়।
অভ্যন্তরীন পাইলসের লক্ষন
- মলত্যাগের সময় ব্যাথাহীন রক্তপাত হয়। (প্রথম পর্যায়ে)
- সমস্যা বেড়ে গেলে রক্তপাতের সময় ব্যাথা হতে পারে।
- মলত্যেগের সময় পাইলস বাইরে বের হয়ে আসে।
- মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত চাপ অনুভূত হয়।
- সমস্যা বেড়ে গিয়ে যদি পাইলস প্রল্যাপসে রূপ নেয় তবে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভূত হয়।
পাইলস হওয়া থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার উপায়
পাইলস পা পায়ুপথের যেকোনো সমস্যার জন্য একমাত্র দায়ী জিনিস হলো আমাদের জীবনধারার পন্থা। পাইলস হতে পারে এমন অভ্যাস বা কারন যেগুলো উপরে উল্লেখ্য করা হয়েছে এগুলো এড়িয়ে চলাই পাইলস থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। তাছাড়া, খাওয়ার অভ্যাসেও বিশেষ পরিবর্তন আনা জরুরি। যথেষ্ট পরিমানে পানি পান করতে হবে এবং ক্যাফিন জাতীর পানীয় পান করা যাবে না। তাছাড়া সাধারন খাবারের মধ্যে, শুকনো ও তেল, ঝাল এবং মশলা যুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। সঠিক ও পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন জীবন-যাপন ও স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ই এই রোগ হওয়া-কে বাধা দেয়ার একমাত্র পন্থা।
পাইলস এর নিয়াময় পদ্ধতি
মলদ্বার সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা হলেই আমাদের যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। এবার সেটা পাইলস হোক বা অন্য কিছু। কারন এটি আমাদের দেহের অন্যতম গুরত্বপূর্ন এবং সংবেদনশীল অঙ্গ। কিন্তু, লজ্জা ও গোপনীয়তার কারনে আমরা সবসময়-ই এটি চেপে যেতে চাই এবং চিকিৎসক বা আমারে কাছের কারো কাছেও সমস্যার কথা শেয়ার করিনা। পরে অসুখের মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন বাধ্য হয়ে দাক্তারের কাছে যাই আমরা। যা একেবারেই উচিত হয় এবং আমাদের কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়িয়ে দেয়। প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসকের সরনাপন্ন হলে মল, ইনজেকশন অথবা রাবার ব্যান্ড লাইগেশনের সাহায্যেই পাইলসের নিরাময় সম্ভব হয়। কিন্তু, সাধারনত বেশিরভাগ পাইলস রোগী ই এমন পর্যায়ে ডাক্তারের সরনাপন্ন হয় যে অপারেশন করে পাইলস কাটা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।
পাইলসের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে। এগুলো হলো –
- ইঞ্জেকশন
- আল্ট্রয়েড
- ক্রায়ো-থেরাপি
- লেজার-থেরাপি
- রিং লাইগেশন ইত্যাদি।
এগুলোর মধ্যে, ক্রায়োথেরাপি, ইঞ্জেকশন এবং আল্ট্রয়েড হলো প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে রোগের মাত্রা বেড়ে গেলে লেজার থেরাপি অথবা রিং লাইগেশন এর দরকার হয়।
পাইলস এর সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হলে এটি ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে। এজন্য শেষ পর্যায়ে যাওয়ার আগেই এর সঠিক চিকিৎসা করা জরুরি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী হলো রিং লাইগেশন। এর দ্বারা শতভাগ রোগী ই পূর্ন নিরাময় লাভ করতে সক্ষম হন। তবে এই চিকিৎসা শুধু তাদের জন্যই করা হয় যাদের অবস্থা একদমই শোচনীয় থাকে। তাছাড়া এই পদ্ধতি প্রচুর ব্যায়বহুল হওয়ায় সব রোগীদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির পরামর্শ চিকিৎসকেরা প্রদান করেন না। যাদের রোগ চরম মাত্রায় থাকে এবং যারা এই চিকিৎসার খরচ সামলানোর মতো সাবলম্বী তাদের জন্য ই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়।
যেসকল রোগীদের জন্য রিং-লাইগেশন প্রয়োগ করা হয় না তাদের লেজার-থেরাপি পদ্ধতি-তে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। লেজার-থেরাপি ও রিং-লাইগেশন এর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। এই পদ্ধতিরে শুধু মাত্র একটি লেজার বীম এর মাধ্যমে আক্রান্ত বা ড্যামেজড সেল গুলোকে ঠিক করা হয় এবং রিং লাইগেশনের মতোই প্রচলিত পদ্ধতিতে পাইলস কেটে অপসারন করতে হয়। উভয় পদ্ধতিতেই পায়পথের কিছু বিশেষ অংশ কাটার প্রয়োজন হয় এবং একই পরিমান কষ্ট অনুভব করতে হয়। আর যেহেতু পায়ুপথে অস্ত্র-পাচার করা হয়, সেহেতু এই ক্ষত শুকাতে অন্য সাধারন ক্ষতের চাইতে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। সাধারন অবস্থায় এটি ১-২মাস সময় নেয়।
তবে, যেকোনো চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ বা ঔষধ সেবনের পূর্বে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া এবং যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নেয়া উচিত।