নিউমোনিয়া কী?
নিউমোনিয়া হলো ফুসফুসের একটি রোগ। এ রোগ হলে ফুসফুসের প্যারেনকাইমা টিস্যুতে প্রদাহ হয়। এ রোগ সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সাধারণত শীতকালে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এটি খুব সাধারণ একটি রোগ কিন্তু চিকিৎসা না নিলে এ রোগ প্রাণঘাতি হতে পারে। সাধারণত বয়স্করা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হয় কেননা তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। তবে তরুণ ও শিশুদেরও এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। যেহেতু এ রোগে ফুসফুসের ক্ষতি হয় সেহেতু এ রোগ হলে রোগীর স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস প্রক্রিয়া ব্যহত হয়। দেহের স্বাভাবিক অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের আদান প্রদান ব্যহত হয়। যার ফলে রোগীর শরীরে কার্বন ডাইঅক্সাইড জমা হতে থাকে। এ রোগ হলে শ্বাসকষ্ট, কাশি, জ্বর, শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে বুকে ব্যাথা হওয়া, শরীর কাঁপুনি দেওয়া ইত্যাদি লক্ষণগুলো দেখা যায়। এটি একটি বায়ুবাহিত রোগ এবং বায়ুবাহিত হওয়ার ফলে এটি দ্রুত ছড়িয়ে যেতে পারে। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশির মাধ্যমে সুস্থ ব্যাক্তির দেহে এ রোগের জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।
নিউমোনিয়া কত প্রকার ও কী কী
চার প্রকারের নিউমোনিয়া রয়েছে। এদের নিচে দেওয়া হলো-
রোগের নাম | বর্ণনা |
---|---|
ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া | ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে যে নিউমোনিয়া হয় সেটিই ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া। সাধারণত স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি (Streptococcus pneumoniae) ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রোগ হয়ে থাকে। |
ভাইরাল নিউমোনিয়া | ভাইরাস দ্বারা ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে যে নিউমোনিয়া হয় সেটিই ভাইরাল নিউমোনিয়া। সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস, কোভিড-১৯ ভাইরাস ইত্যাদি ভাইরাসের আক্রমণে এ এ রোগ হয়ে থাকে। |
মাইকোপ্লাজমাল নিউমোনিয়া বা ওয়াকিং নিউমোনিয়া | এ ধরনের নিউমোনিয়া মাইকোপ্লাজমা নিউমোনি ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে হয়ে থাকে। এটি সাধারণত মৃদু নিউমোনিয়া। অনেক সময় এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পেলেও মানুষ তার স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে। এজন্যই একে ওয়াকিং নিউমোনিয়া ও বলা হয়। |
ফাঙ্গাল নিউমোনিয়া | ছত্রাকের আক্রমণে যে নিউমোনিয়া হয় সেটিই ফাঙ্গাল নিউমোনিয়া। এটি সাধারণত খুব একটা দেখা যায় না। |
আরও পড়ুন : জেনে নিন নিউমোনিয়ার লক্ষণ ও চিকিৎসা।
নিউমোনিয়া রোগের জীবাণু
নিউমোনিয়ার জন্য বেশ কয়েক ধরনের জীবাণু রয়েছে। এদের মধ্যে কোনোটা ব্যাকটেরিয়া, কোনোটা ভাইরাস কিংবা ছত্রাক। আসুন দেখে নেই কোন কোন জীবাণুর কারনে এ রোগ হয়ে থাকে।
১। স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি : এটি এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়ার ফলে মানুষের ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া হয়ে থাকে।
২। ইনফ্লুয়েঞ্জা : এটি এক ধরনের ভাইরাস। এর ফলে ভাইরাল নিউমোনিয়া হয়ে থাকে।
৩। কোভিড-১৯ : করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ ও এক ধরনের ভাইরাস যা মানুষের ফুসফুসকে আক্রমণ করে এবং এ রোগ সৃষ্টি করে।
৪। মাইকোপ্লাজমা নিউমোনি : এটি এক ধরনের মাইকোপ্লাজমা ব্যাকটেরিয়া যার ফলে ওয়াকিং নিউমোনিয়া হয়ে থাকে।
৫। নিউমোসিস্টিস জিরোভেসি নিউমোনিয়া : এটি এক ধরনের ছত্রাক যা মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে প্রবেশ করে এ রোগ সৃষ্টি করে।
আরও পড়ুন : ম্যালেরিয়া জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার
ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া
এ ধরনের নিউমোনিয়া স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে হয়ে থাকে। বেশিরভাগ নিউমোনিয়াই সাধারণত ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া হয়ে থাকে। এটি সাধারণত হাঁচি, কাশি, সর্দি, কফ ইত্যাদির মাধ্যমে অসুস্থ ব্যাক্তি থেকে সুস্থ ব্যাক্তির দেহে ছড়ায়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হলে এ রোগে সহজেই আক্রান্ত হয়। এর সাধারণ কিছু লক্ষণ হলো কফ মিশ্রিত কাশি, জ্বর, শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি। সাধারণত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ রোগের জন্য এন্টিবায়েটিক দিয়ে থাকেন। সব ধরনের নিউমোনিয়ার মধ্যে ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়াই সবচেয়ে কমন এবং এটিই সবচেয়ে গুরুতর। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করলে সহজেই ভালো হবে নতুবা এ রোগ প্রাণঘাতি ও হতে পারে। সাধারণত এন্টিবায়েটিকেই এ রোগ ভালো হয়ে যায়। তবে রোগীর অবস্থা খারাপ হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক শিরায় এন্টিবায়েটিক সমৃদ্ধ তরল দিতে পারেন। এছাড়া রোগীর অক্সিজেনের দরকার হতে পারে। শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য আলাদা চিকিৎসা ও করানো লাগতে পারে।
ভাইরাল নিউমোনিয়া
ভাইরাসের ফলে যে নিউমোনিয়া হয় সেটিই ভাইরাল নিউমোনিয়া। অনেক ধরনের ভাইরাসই রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কমন ভাইরাসগুলো হলো ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এবং করোনাভাইরাস। ভাইরাল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে যে সকল লক্ষণ দেখা যায় তা হলো : জ্বর, ঠান্ডা, শুকনা কাশি, বন্ধ নাক, মাথা ব্যথা, মাংশপেশিতে ব্যথা, ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্ততা ইত্যাদি। ভাইরাল নিউমোনিয়ায় এন্টিবায়েটিক কোনো কাজ করবে না কেননা এন্টিবায়েটিক শুধু ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধেই কর্মক্ষম। এর চিকিৎসা শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে করতে হয়। ভাইরাল নিউমোনিয়া সাধারণত গুরুতর হয় না এবং সহজেই ভালো হয়ে যায়। বেশি বেশি তরল জাতীয় খাবার খেতে হয়। এতে বুকের কফ পাতলা হয় এবং ব্যথা কমে। ব্যথা এবং জ্বরের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিছু ওষুধ দিবেন।
ফাঙ্গাল নিউমোনিয়া
ছত্রাকের আক্রমণে এ ধরনের নিউমোনিয়া হয়ে থাকে। সাধারণত আক্রমণকারী ছত্রাকের স্পোর শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে ঢুকে পড়ে এবং সেখানে স্পোর থেকে ছত্রাকের জন্ম হয় যা ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি করে। তবে এ ধরনের নিউমোনিয়া খুবই কম দেখা যায়। দূর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাক্তি এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। কিছু স্পেশাল কারনে একজন মানুষের ও খুব দ্রুত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কারন গুলো হলো অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে, ক্যান্সার রোগীর ক্যামোথেরাপির ফলে, বিভিন্ন অটোইমিউন রোগের চিকিৎসার ফলে, এইডস হলে। এসবের কারনে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে এবং তারা ফাঙ্গাল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে ভয়ের কিছু নেই। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মাইকোপ্লাজমাল নিউমোনিয়া
পূর্বে মাইকোপ্লাজমাকে ব্যাকটেরিয়া হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বর্তমানে এদের আলাদা করা হয়েছে। এরা মূলত ব্যাকটেরিয়ার মত হলেও আকারে ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে অনেক ছোট। মাইকোপ্লাজমা নিউমোনি নামক মাইকোপ্লাজমা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা এ রোগ হয়ে থাকে। এ ধরনের নিউমোনিয়াকে ওয়াকিং নিউমোনিয়া ও বলা হয়ে থাকে। ওয়াকিং নিউমোনিয়া বলার কারন হচ্ছে এ রোগে মানুষের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হয় না। এন্টিবায়েটিক ব্যবহারে এ রোগ ভালো হয়ে যায়। এটি সবচেয়ে মৃদু এবং এ রোগ হলে অনেক সময় আপনি বুঝতেই পারবেন না যে আপনার নিউমোনিয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন : টাইফয়েড জ্বর ভালো করার উপায়
নিউমোনিয়া প্রতিরোধের উপায়
এ রোগ প্রতিরোধের উপায়গুলো হলো-
- শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
- সবুজ শাকসবজি ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে।
- প্রতিদিন শারীরিক পরিশ্রম অথবা ব্যায়াম করতে হবে।
- শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
- ঘরের পরিবেশ গরম রাখতে হবে।
- ঘরে যথেষ্ট আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- শীতকালে এ রোগ বেশি ছড়ায়। তাই শীতকালে শরীরের তাপমাত্রা গরম রাখতে হবে।
- ধূমপান, মদ্যপান সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে শিশু বা বয়স্ক লোকদের যোগাযোগ পরিহার করতে হবে।
- আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, সর্দি, কফ ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে হবে।
- পরিমিত পরিমানে পানি পান করতে হবে।
- আক্রান্ত ব্যক্তি দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন : ডায়াবেটিস রোগীর খাবার তালিকা এবং নিষিদ্ধ খাবারের তালিকা
Frequently Asked Questions (FAQs)
প্রশ্ন: নিউমোনিয়া কি ছোঁয়াচে রোগ?
উত্তর: হ্যাঁ। আক্রান্ত রোগীর হাঁচি, কাশি, সর্দি, কফ থেকে এ রোগ ছড়াতে পারে।
প্রশ্ন : নিউমোনিয়া কী বাহিত রোগ?
উত্তর: বায়ুবাহিত।
প্রশ্ন: নিউমোনিয়ার ইংরেজি বানান কী?
উত্তর : Pneumonia
প্রশ্ন : নিউমোনিয়ার প্রধান লক্ষণ কী?
উত্তর: শ্বাসকষ্ট, কাশি ও বুকে ব্যথা।
প্রশ্ন: কোভিড নিউমোনিয়া কী?
উত্তর : করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ ভাইরাস যে নিউমোনিয়া সৃষ্টি করে সেটিই কোভিড নিউমোনিয়া।
Disclaimer :এ ওয়েবসাইটে দেওয়া সকল তথ্য শুধুমাত্র জানার জন্য। রোগীকে সরাসরি না দেখে এবং রোগীর পরীক্ষা না করে রোগ এবং রোগের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। তাই নিজে নিজে কোনো ওষুধ খাবেন না। অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।