সাপ কি নিজে থেকেই আক্রমন করে?
সাপ সচরাচর নিজে থেকে মানুষকে কামড়ায় না বা তেড়ে আসে না। সাপ তৃতীয় শ্রেনীর প্রানী এবং আমরা সাপ দেখলে যতটা ভয় পাই সাপ আমাদের দেখলে তার থেকেও বেশি ভয় পায়। যার কারনে সাপ আপনাকে কখনোই নিজে থেকে আক্রমন করবে না। সাপের বুকের তলাইয় এক বিশেষ ধরনের স্নায়ু থাকে যা দ্বারা সাপ মাটিরে হওয়া যেকোনো কম্পন বুঝতে পারে। আর এই কম্পনের দ্বারা সাপ ঐ প্রানী/বস্তুর দূরত্ব, আকার-আকৃতি সকল কিছুর একটা ধারনা পেয়ে যায় এবং বিপদ বুঝতে পারলে সেই জায়গা থেকে পালিয়ে যায়। এক্ষেত্রে রাতে বা ঝোপঝাড়ের মধ্যে হাটার সময় ভারী পায়ে শব্দ করে বা লাঠী বা অন্য কিছুর মাধ্যমে শব্দ করে চলাফেরা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
তবুও সাপ যে মানুষকে একেবারেই কামড়ায় না এটা যে সত্যি না সেটা আমরা সবাই জানি। এখন, মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে ভয় পেলে তবে কেনো কামড়াতে বা তেড়ে আসে আমাদের? আসুন জেনে নিই সেই কারনগুলোঃ–
সাপ মানুষকে কেনো কামড়ায়?
সাপ মানুষের উপস্থিতি টের পেলে বা কারো মুখোমুখি হলে সাথে সাথেই পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। তবে কোনো কারনে সে যদি ভয় পায়, বা আপনি যদি নিজে থেকেই তাকে আক্রমন করেন বা ভুলবশত গায়ে পা দিয়ে ফেলেন, তখনই শুধুমাত্র আত্মরক্ষার জন্য সে মানুষকে আক্রমন করে বা কামড়ায় এবং সাথে সাথেই পালিয়ে যায়। মূল কারন মূলত এগুলোই, তাছাড়া সাপ দেখলেই আমাদের মনে হয় এই বুঝি আসলো আমাদের আক্রমন করতে এবং আমরা তেড়ে যাই সাপের দিকে। তাছাড়া, যারা রাতে কাজ করেন, বিশেষ করে জেলেরা, যারা রাতে মাছ ধরেন বা নদী/খাল/পুকুরের পাড়ে চলাফেরা করেন তাদের অসাবধানতার কারনেও সাপের দংশনের শিকার হতে হয়। সাপ রাতে শুকনো জায়গার খোজে বা মাছ ধরে এনে খাওয়ার জন্য এই যায়গা গুলোতে বসে থাকে তখন। আমাদের সাপ দেখলে তাকে বিরক্ত না করা, ভালোমতো দেখেশুনে চলাফেরা করা এবং সাপের সামনাসামনি হলে তাকে সরে যেতে দেয়ার মাধ্যমেই সাপের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি আমরা।
সাপে কাটলে কী করনীয়?
সাপে কাটলে একদমই ঘাবড়াবেন না। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রনে রাখুন। রক্তপ্রবাহ বেড়ে গেলে বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পরবে। দংশনের স্থান নাড়াচাড়া করবেন না। সাপ যদি পায়ে কামড়ায় তবে নিজে থেকে হাটবেন না। ক্ষতস্থানের উপরে কিছু দিয়ে বেধে নিন। তবে সাবধান বেশি শক্ত করে বাধবেন না, তাহলে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হাত বা পায়ে পচন ধরবে। আটসাট করে গামছা বা এজাতীয় কিছু দিয়ে ক্ষতস্থানের কিছুটা উপরে বেধে নিন। ভুলেও বিদ্যুতের তার, দড়ি বা এজাতীয় কিছু দিয়ে বাধবেন না। বাধনের মাঝে যাতে দুইটা আঙ্গুল ঢুকানো যায় এমনটা ঢিলা রাখুন তবে বেশি ঢিলা করে বাধবেন না। আর কিছুক্ষন পর পর বাধন খুলে খুলে আবার বাধুন। এতে করে বিষ ও ধীরে ছড়াবে এবং রক্ত চলাচল সম্পূর্ন বন্ধ হয়ে পচন ধরার সম্ভাবনা ও থাকবে না। তাছাড়া সাপে কাটলে হাতের চুড়ী, ব্রেসলেট, আংটি খুলে ফেলুন। সাপের বিষের প্রভাবে হাত, পা বা আঙ্গুল ফুলে গেলে তখন আংটি বা চুড়ি আটকে গিয়ে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে গিয়ে পচন শুরু হতে পারে। এসবই ছিলো প্রাথমিক পদক্ষেপ, এরপর সাথে সাথে রোগী-কে নিকটস্থ কোনো সরকারি হাসপাতালে দ্রুত নিয়ে যান। ওঝার কাছে গিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। মনে রাখবেন, আপনার অন্ধবিশ্বাসের থেকে রোগীর প্রানের মূল্য বেশি এবং ওঝার ঝাড়ফুকের থেকে এন্টিভেনমের ক্ষমতা বেশি।
আরও পড়ুন : ম্যালেরিয়া জ্বরের লক্ষণ ও প্রতিকার
সাপে কাটা ও সাপ নিয়ে আমাদের কিছু ভূল ধারনা।
১. ভুলেও দংশনের স্থানে মুখ লাগিয়ে বিষ চুষে বের করতে যাবেন না। এটা শুধুমাত্র সিনেমায় ই মানায়, বাস্তবে নয়।
২. ক্ষতস্থান ধারালো কোনো ব্লেড বা ছুড়ি দিয়ে কাটতে যাবেন না। এতে করে বিষ বের হয় না বরং রক্তের সাথে দ্রুত মিশে যায়।
৩. আমাদের গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদের প্রচলন আছে যে, সাপে কাটার পর যদি ঐ সাপকে যদি আপনি কামড় দেন তাহলে বিষ পুনরায় সাপের শরীরে চলে যাবে। এটা সম্পূর্ন ভূল একটা ধারনা, ধরুন সাপ আপনার পায়ে কামড়েছে, বিষ সেখানেই আছে এবং মানুষের দাতেও কোনো বিষ নেই যে আপনি সাপকে ক্ষতি করবেন। বরং এতে করে পুনরায় দংশিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।
৪. কার্বলিক এসিড সাপ তাড়াতে বা সাপকে দূরে রাখে না। এটি আমাদের শিক্ষিত সমাজেও অনেকে বিশ্বাস করলেও এর কোনো বিজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সাপের ঘ্রান শক্তি প্রখর, সাপ গন্ধ শুকে শুকেই তার শিকার শনাক্ত করে থাকে। তবুও কার্বলিক এসিডের কড়া গন্ধ সাপের কাছে মোটেও বিরক্তিকর কিছু নয়। আসলে ঐ গন্ধের কারনে এসিডের আশে পাশে পোকা মাকড় আসে না এবং আশে পাশে খাওয়ার মট শিকার থাকে না বলেই মূলত সাপ আসে না। এমনও উদাহারন বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায় দেখা গিয়েছে যে কার্বলিক এসিডের বোতলের পাশেই গোখরা সাপ ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়েছে। তাছাড়া, কার্বলিক এসিড দাহ্য পদার্থ এবং বিষাক্ত। দীর্ঘদিন ধরে ঘরে এই এসিডের বোতল ঘরে খোলা অবস্থায় রেখে দিলে তা বাতাসের সাথে মিশে মানুষের জন্য স্লো-পয়জন হিসেবেও কাজ করতে পারে। তাছাড়া, ভূলবশত এই এসিড কারো গায়ে পড়লে ত্বক পুড়ে বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হতে পারে।
৫. কার্বলিক এসিড ছাড়াও অনেকে মনে করেন যে বেলি ফুল অথবা হাসনেহেনা ফুল বাড়ির আশে পাশে থাকলে সেখানে সাপ আসার সম্ভাবনা থাকে না। এই ধারনা ও ভূল। ফুলের গন্ধে সহজেই বিভিন্ন পোকামাকড় সেখানে আসবে এবং পোকামাকড় খেতে ব্যাঙ আর ব্যাঙ খেতে আসবে সাপ।
৬. বাংলা, হিন্দি ও ভারতীয়-বাংলা সিনেমার বদৌলতে আমাদের মাঝে এই ধারনা ভালো ভাবেই তৈরি হয়েছে যে একটা সাপকে মারলে ঐ সাপের সঙ্গী প্রতিশোধ নিতে আসে। আগেই বলেছি সাপ নিম্নশ্রেনীর প্রানী। এদের মানুষের মতো প্রখর স্মৃতিশক্তি নেই যে আপনাকে পিছু করে আপনার বাসায় গিয়ে আপনার উপর প্রতিশোধ নিবে। তবে হ্যা, একটা সাপকে মারার পর ঐ যায়গায় মাঝে মাঝে অন্য একটা সাপকে দেখা যায়, এটা তখনই হয় যদি ঐ যায়গাটা তাদের মেটিং স্পট হয়। স্বাভাবিক ভাবেই মেটিং এর জন্যই অন্য সাপটি সেখানে আসে, আপনার উপর প্রতিশোধ নিতে নয়।
৭. আমাদের অনেকের ই ধারনা যে বাচ্চা সাপের কোনো বিষ নেই। এটিও একটি ভ্রান্ত ধারনা। বাচ্চা হলেও সে ও সাপই। যদিও বাংলাদেশের ৮০ প্রজাতির সাপের মধ্যে মধ্যে মাত্র ২৭ প্রজাতি-ই বিষধর। তবে এই ২৭প্রজাতির মধ্যে মাত্র ৫/৬ প্রজাতির সাপই স্থলে বাস করে। বাকি সব সামুদ্রিক সাপ। কিন্তু, সাপ যদি বিষধর প্রজাতির হয় তবে সে বাচ্চা হলেও তার বিষ থাকবে এবং সাপ নির্বিষ প্রজাতির হলে প্রাপ্তবয়স্ক সাপের ও বিষ থাকবে না। এক্ষেত্রে বিষধর প্রজাতির বাচ্চা সাপ বরং বেশি ক্ষতিকর। কারন, আত্মরক্ষার জন্য ঠিক কতটূকু বিষ প্রয়োগ করতে হবে তার কোনো ধারনাই থাকেনা বাচ্চা সাপের এবং যার কারনে বেশি বিষ প্রয়োগ করে যা আরো বেশি মারাত্মক। এক্ষেত্রে সঠিক চিকিৎসা করেও সুস্থ হবার সম্ভাবনা কমে যায়।
৮. ওঝা রা বিষ নামাতে পারে না। এটা ও একটা ভ্রান্ত ধারনা। আগেই বলেছি বাংলাদেশের বেশিরভাগ সাপ-ই নির্বিষ এবং কিছু সাপ আছে যারা মৃদু-বিষধর। নির্বিষ হলে কিছুই হয় না এবং মৃদু বিষধর হলে, বমি, মাথা ব্যাথা এর থেকে বেশি কিছু হয় না। এমন অবস্থায় ওঝারা শুধু শুধুই মানুষকে শুরুতে ভয় দেখায় এবং পরে সে সুস্থ করেছে বলে অর্থ কামিয়ে নেয়। তবে মাঝে মাঝে বিষধর সাপ হলে কিছুক্ষন পরেই রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, তখন তারা অবস্থা বুঝতে পেরে রোগীর শারীরিক সক্ষমতার বা নাগ-নাগীনির উদাহরন দিয়ে শেষ পর্যন্ত রোগী-কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলে।
৯. সাপের দাতে বিষ থাকে না। দাত দিয়ে ক্ষত করে এবং একই স্থানেই থাকে বিষের থলি। সেখান থেকে ক্ষতস্থানে বিষ ঢুকিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন : দ্রুত বীর্যপাতের কারন, চিকিৎসা ও ঔষধ
বাড়ীতে সাপ আসা আটকাবেন কীভাবে?
বাড়ীর আশে-পাশে ঝোপঝাড় রাখবেন না। আবর্জনা, খড় বা কাঠের স্তুপ থাকলে পরিষ্কার করে রাখুন। ঘরের আশে-পাশে ইদুরের বা অন্য কিছুর গর্ত থাকলে তা ভরাট করে দিন। সাপের খাবার, যেমন, ইদুর, ব্যাঙ, শামুক ইত্যাদির উৎপাত যাতে না হয় সে ব্যাবস্থা নিন। তবুও, বর্ষাকালে সাপ ঘরে বা ঘরের আশেপাশে আশ্রয় নিতে পারে। রাতের বেলায় দেখে শুনে এবং শব্দ করে চলাফেরা করুন। ঘরবাড়ী/কাপড় রাখার স্থান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন। খাবার এবং লুকানোর যায়গা না থাকলে সাপও আসবে না|
বিষধর সাপে কেটেছে কিনা বুঝার উপায়?
বিষধর সাপের কামড় চিনতে পারাটা খুব একতা কঠিন কাজ নয়। বিষধর সাপের বাকানো দুটি বড় আকারের দাত থাকে। বিষধর সাপ দংশন করলে কামড়ের স্থানে গভীর ক্ষত হয়। সাধারনত দুটি দাতের দাগ/ক্ষত দেখলেই ধরে নিতে পারেন যে আপনাকে বিষধর সাপে কামড়েছে। তাছাড়া বিষের প্রতিক্রিয়া থেকেও বুঝা যায় যে বিষধর সাপ কিনা বা কোন সাপে কামড়েছে। উদাহরন স্বরূপ, চন্দ্রবোড়া সাপ যদি দংশন করে তবে রক্তের লোহিত রক্তকনিকা ভেঙ্গে যায় যার ফলস্বরুপ কামড়ের স্থান থেকে রক্ত পড়া, রক্ত বমি, ফুলে যাওয়া, ফোস্কা পড়া সহ পায়খানার সাথে রক্ত বের হতে পারে। তবে মাঝে মাঝে নির্বিষ সাপের কামড়েও শুধুমাত্র ভয়ে হার্ট এট্যাকের কারনেও অনেকে মারা যায়।
সর্বোপরি, সাপ দেখলে তাকে তার মতো চলে যেতে দিন, সাবধানে চলাফেরা করুন, ঘর-বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখুন এবং কুসংস্কার থেকে বিরত থাকুন এবং অযথা সাপ মারা থেকেও বিরত থাকুন। সকল প্রানীর ই প্রকৃতিতে অবদান রয়েছে।
আরও পড়ুন : সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠুন যক্ষা থেকে – কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা
Disclaimer : এ ওয়েবসাইটে দেওয়া সকল তথ্য শুধুমাত্র জানার জন্য। রোগীকে সরাসরি না দেখে এবং রোগীর পরীক্ষা না করে রোগ এবং রোগের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। তাই নিজে নিজে কোনো ওষুধ খাবেন না। অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।