Skip to content

জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ

জলাতঙ্ক হলো একটি ভাইরাসজনিত রোগ ইংরেজীতে যাকে বলা হয় Rabies. এই ভাইরাসের নাম রেবিস ভাইরাস। এ রোগের লক্ষণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ নিয়ে আলোচনা করবো আজ।

ভূমিকা

এ রোগ খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকেই মানুষের কাছে পরিচিত। এই রোগটি অন্য প্রানি থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। এজন্য একে জুনোটিক রোগ বলা হয়। সাধারণত কিছু গৃহপালিত ও বন্য প্রানির লালায় এই রোগের জীবাণু রেবিস ভাইরাস বাস করে এবং এদের মাধ্যমেই রেবিস ভাইরাস মানুষের শরীরে চলে আসে এবং জলাতঙ্ক হয়। সাধারণত কুকুর, শিয়াল, বিড়াল, বানর, বাদুর ইত্যাদি প্রানি এই জীবাণু বহন করেবাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। সাধারণত আফ্রিকা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়ায় এই রোগের প্রকোপ বেশি। একবার কোনো মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লে তাকে বাঁচানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে কুকুর, বিড়াল বেশি থাকায় এ রোগের ঝুঁকিও বেশি। বিশেষ করে পাগলা কুকুরের হাত থেকে দূরে থাকতে হবে। এরা যেকোনো সময় মানুষকে কামড়ে দিতে পারে এবং এ রোগের কারন হতে পারে। এই রোগকে “হইড্রোফোবিয়া” বা “পানিভীতি” রোগ ও বলা হয়।

জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ

কীভাবে জলাতঙ্ক হয়?

এ রোগ সাধারণত কিছু গৃহপালিত ও বন্য প্রানির শরীর থেকে মানুষের শরীরে আসে। প্রথমে এই রেবিস ভাইরাস এইসব প্রানিগুলোকে আক্রমণ করে। এদের মধ্যে অন্যতম প্রানি হলো কুকুর, বিড়াল, বানর, বেজি, শিয়াল, বাদুর ইত্যাদি। এইসকল প্রানিগুলোর শরীর থেকে এদের কামড় কিংবা আঁচড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে পৌঁছে যায় রেবিস ভাইরাস। মানুষের শরীরে পৌঁছানোর পর রোগ প্রকাশে প্রায় ২-১৬ সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। রেবিস ভাইরাস মূলত মানুষের মস্তিষ্ককে আক্রমণ করে। এজন্য পায়ের তুলনায় মাথায় কামড়ালে রোগ তাড়াতাড়ি প্রকাশ পায় কারন পায়ে কামড়ালে ঐ জীবাণুকে মাথার মস্তিষ্ক পর্যন্ত আসতে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয় এবং সময় লেগে যায়। আক্রান্ত স্হান থেকে রেবিস ভাইরাস মানুষের স্নায়ুকোষের মাধ্যমে মস্তিষ্কের দিকে এগোতে থাকে এবং এই সময়টাতে কোনো রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায় না। মস্তিষ্কে পৌঁছানোর পর এরা বংশবৃদ্ধি করতে থাকে।

আরও পড়ুন : সাপে কাটলে কী করনীয়?

জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ

এ রোগের লক্ষণগুলো নিচে দেয়া হলো –

  • প্রথমদিকে সাধারণ কিছু লক্ষণ যেমন জ্বর, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি দেখা দেয়।
  • যেহেতু এর আরেক নাম “হাইড্রোফোবিয়া” তাই পানির প্রতি ভীতি দেখা দেয়। হাইড্রো মানে হলো পানি এবং ফোবিয়া মানে হলো ভয়। সুতরাং হাইড্রোফোবিয়া মানে হলো পানির প্রতি ভয়।
  • মাংসপেশিতে ব্যথা অনুভব হতে পারে।
  • শরীরে ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্ত ভাব আসতে পারে।
  • মাথা ঘোরা দেখা দেয়।
  • হ্যালুসিনেশন হয়।
  • বমি বমি ভাব দেখা দেয়।
  • খাওয়া দাওয়ায় অরুচি দেখা দেয়।
  • আক্রান্ত স্হানে চিনচিন হতে পারে।
  • আক্রান্ত ব্যক্তির পানির পিপাসা পেলেও পানি দেখলেই তিনি প্রচণ্ড ভয় পান।
  • খাবার খেতে কষ্ট হয়। বিশেষ করে খাবার গিলতে।
  • মুখ থেকে লালা নিঃসৃত হয়।
  • ব্যক্তি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
  • শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়।
  • খিঁচুনি হয়।
  • ব্যক্তির মাঝে ঝিমুনি ভাব চলে আসে।
  • শরীরের শ্বাসপ্রশ্বাসের সমন্বয়ের অভাব দেখা দেয়। ফলে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
  • আক্রান্ত ব্যক্তি পক্ষাঘাতগ্রস্ত বা প্যারালাইজড হয়ে যেতে পারেন।
  • অন্ধকারে থাকতে পছন্দ করেন।
  • আলো বাতাস দেখলেই প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান।
  • হাইড্রোফোবিয়ার পাশাপাশি এরোফোবিয়া (বাতাসের প্রতি ভয়) ও দেখা দেয়।
  • কখনও কখনও রোগী কোমায় চলে যেতে পারে।
  • শরীরে চেতনাশূন্যতা দেখা দেয়।
  • শেষ পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তি অবধারিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা

এই রোগ একবার হলে মৃত্যু অনিবার্য। এই রোগ হওয়ার পরের কোনো প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কার হয়নি। সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মধ্যেই রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে। এই রোগ একবার হয়ে গেলে সম্পূর্ণভাবে সারিয়ে তোলা সম্ভব নয় কিন্তু চিকিৎসার মাধ্যমে যন্ত্রণা উপশম করা সম্ভব। এই রোগের একমাত্র চিকিৎসা হলো টিকা গ্রহন। তবে এই টিকা গ্রহন অবশ্যই এই রোগ হওয়ার আগেই করতে হবে। রোগাক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর টিকা গ্রহন করলে কোনো কাজেই দিবে না। রেবিস ভাইরাস থাকতে পারে এমন কোনো প্রানি কামড় দিলে বা আঁচড় দিলে সময়ক্ষেপণ না করে অতিসত্বর টিকা গ্রহণ করলে এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব

 

জলাতঙ্ক প্রতিরোধ

এ রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো টিকা। শুধুমাত্র টিকা গ্রহনের মাধ্যমেই এ রোগের প্রতিরোধ সম্ভব। এখন পর্যন্ত  বিভিন্ন টিকা আবিষ্কার হলেও সবচেয়ে নিরাপদ টিকা হলো হিউম্যান ডিপ্লয়েড সেল ভ্যাকসিন (HDCV)। বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে এ টিকার তথ্য সবাইকে জানাতে হবে এবং সমাজের সবাইকে এ টিকা গ্রহনের মাধ্যমে এ রোগের মাধ্যমে মৃত্যহার অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। যাদের বাড়িতে পোষা কুকুর বা বিড়াল রয়েছে তাদের অবশ্যই এ টিকা নেওয়া আবশ্যক। পশুচিকিৎসক কিংবা চিড়িয়াখানায় দেখাশোনা করে এমন লোকের এ রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকায় তাদেরও এ রোগের টিকা নেওয়া আবশ্যক।

আরও পড়ুন : এজমা/হাঁপানি থেকে মুক্তির উপায়

জলাতঙ্ক রোগের টিকা দেওয়ার নিয়ম

এ রোগের জন্য সাধারণত দুই ধরনের টিকা দেওয়া হয় :-

১। প্রাক – এক্সপোজার টিকা :

রেবিস ভাইরাস আক্রমণের পূর্বেই অর্থাৎ রেবিস ভাইরাস বহনে সক্ষম এমন কোনো প্রানির আক্রমণের পূর্বেই প্রতিষেধকমূলক হিসেবে যে টিকা নেওয়া হয় সেটি হলো প্রাক – এক্সপোজার অথবা প্রি – এক্সপোজার টিকা। সাধারণত যাদের বাড়িতে পোষা কুকুর, বিড়াল রয়েছে, পশুচিকিৎসক কিংবা যারা চিড়িয়াখানায় কাজ করে তাদের এই টিকা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত এই টিকার কোর্সে ৩টি ডোজ ও একটি বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়। ০, ৭, ২১ বা ২৮ তম দিনে তিনটি ডোজ এবং প্রতিবছর বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়।

২। পোস্ট – এক্সপোজার টিকা :

রেবিস ভাইরাসের সুপ্তাবস্হাকালে কিংবা রেবিস ভাইরাস বহন করে এমন কোনো প্রানির আক্রমণের পর যে টিকা নেওয়া হয় সেটি হলো পোস্ট – এক্সপোজার টিকা। অবশ্যই নিয়মিত রুটিনমাফিক এ টিকা সম্পন্ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে টিকার ৬ টি ডোজ দেওয়া হয়। ৫টি নরমাল ডোজ এবং একটি বুস্টার ডোজ থাকে এ টিকার কোর্সে। ০, ৩, ৭, ১৪ ও ২৮ তম দিনে ৫টি ডোজ এবং ৯০ তম দিনে একটি বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়। নাভির চারপাশে এ টিকা নেওয়া হয়। এই পোস্ট এক্সপোজার টিকা হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে।

যদি আক্রমণ করা পশুটিকে ধরা যায় তাহলে তাকে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে তার মধ্যে রেবিস ভাইরাস আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে প্রানিটিকে মেরে ফেলতে হবে যাতে অন্য কোনো মানুষ কিংবা প্রানিকে এ রোগে আক্রান্ত করতে না পারে। এবং আক্রান্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই পোস্ট – এক্সপোজার টিকা দিতে হবে।

 

যেসব প্রানির কামড়ে জলাতঙ্ক ছড়ায় না

ইঁদুর, গুঁইসাপ, কাঠবিড়ালী, খরগোশ, ইত্যাদি প্রানির কামড়ে এ রোগ ছড়ায় না। তবে এরা অন্য রোগ বহন করতে পারে যেমন ইঁদুর প্লেগ রোগ বহন করতে পারে। গুঁইসাপ বিষধর, কিন্তু এদের বিষ এতোই দুর্বল যে মানুষের শরীরে কিছুই করতে পারে না। তবে এদের মুখে প্রচুর ব্যাকটেরিয়া থাকায় এরা কামড় দিলে আক্রান্ত স্হান ভালোকরে পরিষ্কার করে নিতে হবে এবং জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। প্রয়োজনে এসব প্রানির কামড়ে টিটেনাস টিকা নেওয়া লাগতে পারে।

এটি মস্তিষ্কের এমন একটি গুরুতর অসুখ, যেটা প্রতিরোধের জন্য কোনো ধরনের অবহেলা করা যাবে না। অন্তঃসত্ত্বা, স্তন্যদানকারী মা, নবজাতক শিশু, অতিবয়স্ক ব্যক্তিও টিকা নিতে পারবেন। কোনো রকম সন্দেহ, প্রশ্ন থাকলেও অসুখের ভয়াবহতা বিবেচনা করে টিকা নিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

Disclaimer : এ ওয়েবসাইটে দেওয়া সকল তথ্য শুধুমাত্র জানার জন্য। রোগীকে সরাসরি না দেখে এবং রোগীর পরীক্ষা না করে রোগ এবং রোগের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। তাই নিজে নিজে কোনো ওষুধ খাবেন না। অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন।

Reference:

  1. Rabies Wiki
  2. Featured Image