Skip to content

জেনে নিন মানবদেহের পরিপাকতন্ত্র কিভাবে কাজ করে

পরিপাক কাকে বলে

যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জটিল খাদ্যবস্তু বিভিন্ন এনজাইম ও হরমোনের সহায়তায় সরল ও তরল এবং দেহকোষের গ্রহণ উপযোগী খাদ্যে পরিণত হয় তাকে পরিপাক বলে।
পরিপাক দুই প্রকার। যথা :
১। যান্ত্রিক পরিপাক ও
২। রাসায়নিক পরিপাক

যান্ত্রিক পরিপাক

যে প্রক্রিয়ায় গৃহীত খাদ্য পৌষ্টিকনালি অতিক্রমের সময় নালির বিভিন্ন অংশের সঞ্চালনের ফলে খাদ্য ভেঙ্গে অতি ক্ষুদ্র টুকরায় পরিণত হয়, তাকে যান্ত্রিক পরিপাক বলে।

রাসায়নিক পরিপাক

যে প্রক্রিয়ায় গৃহীত খাদ্য পৌষ্টিকনালির এসিড, ক্ষার ও এনজাইমের সহায়তায় রাসায়নিক ভাঙ্গনের মাধ্যমে দেহকোষের গ্রহণীয় উপাদানে পরিণত হয় তাকে রাসায়নিক পরিপাক বলে।

জেনে-নিন-মানবদেহের-পরিপাকতন্ত্র-কিভাবে-কাজ-করে how the human digestive system works

মানবদেহের পৌষ্টিকতন্ত্র বা পরিপাকতন্ত্র

মানবদেহের পৌষ্টিকতন্ত্র বা পরিপাকতন্ত্র দুটি অংশ নিয়ে গঠিত। যথা :-
১। পৌষ্টিকনালি (Alimentary Canal)
২। পৌষ্টিকগ্রন্থি (Digestive Glands)

পৌষ্টিকনালি

মানবদেহের পৌষ্টিকনালি মুখছিদ্র, মুখগহ্বর, গলবিল, অন্ননালী, পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র ও পায়ু নিয়ে গঠিত।

পৌষ্টিকগ্রন্থি

মানবদেহের পৌষ্টিকগ্রন্থি লালাগ্রন্থি, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, গ্যাস্ট্রিকগ্রন্থি ও আন্ত্রিকগ্রন্থি নিয়ে গঠিত।

আরও পড়ুন : ম্যালেরিয়া জ্বরের লক্ষণ, প্রতিকার, ওষুধ ও টিকা

মানবদেহের খাদ্য পরিপাকের প্রক্রিয়া

মানবদেহের খাদ্য পরিপাকের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে তিনটি ভাগে ভাগ করে নিচে উপস্থাপন করা হলো-

১। মুখগহ্বরে খাদ্য পরিপাক

ক) মুখগহ্বরের গঠন : মানুষের মুখ গহ্বর বা Buccal Cavity দাঁত, জিহ্বা, শক্ত তালু, নরম তালু, আলজিহ্বা বা এপিগ্লটিস, স্বাদগ্রন্থি ও লালা গ্রন্থি নিয়ে গঠিত।

খ) যান্ত্রিক পরিপাক : খাদ্য গ্রহনের পর স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্ক যে সংকেত পায় তার প্রেক্ষিতে লালাগ্রন্থিগুলো লালা নিঃসরণ করে। লালা মূলত খাদ্যকে নরম, মসৃণ ও পিচ্ছিল করে থাকে। চার ধরনের দাঁতের (ইনসিসর, ক্যানাইন, প্রিমোলার ও মোলার) সাহায্যে বড় খাদ্যখন্ডগুলো ছোট টুকরায় পরিণত হয়। জিহ্বা নড়াচড়া ও সংকোচন প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্যকে লালার সাথে ভালোভাবে মেশায়, দাঁতকে খাদ্য চূর্ণ করতে সাহায্য করে এবং খাদ্য গিলতে সাহায্য করে। জিহ্বার গোড়ায় অবস্থিত এপিগ্লটিস বা আলজিহ্বা খাদ্যকে শ্বাসনালীতে প্রবেশে বাধা দেয়।

গ) রাসায়নিক পরিপাক : মুখগহ্বরে মূলত কার্বোহাইড্রেট বা শর্করার পরিপাক হয়ে থাকে। লালায় অবস্থিত টায়ালিন এনজাইম শর্করা পরিপাকে সাহায্য করে। টায়ালিন এনজাইম জটিল শর্করাকে ভেঙ্গে মল্টোজে পরিণত করে। এ মল্টোজ, মল্টেজ এনজাইমের মাধ্যমে গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়। মুখগহ্বরে প্রোটিন ও লিপিডের পরিপাকের জন্য কোনো এনজাইম থাকে না বিধায় এখানে প্রোটিন ও লিপিডের পরিপাক সংঘটিত হয় না।

২। পাকস্থলীতে খাদ্য পরিপাক

ক) পাকস্থলীর গঠন : পাকস্থলী ডায়াফ্রামের নিচে এবং উদরের উপরে অবস্থিত বাঁকানো থলির মতো দেখতে। পাকস্থলী ২ ভাগে বিভক্ত এবং এগুলো হলো কার্ডিয়াক ও পাইলোরিক। পাকস্থলীর যে অংশে অন্ননালী উন্মুক্ত হয় সে অংশটি হলো কার্ডিয়া। পাকস্থলীর ডানপাশ অবতল এবং একে ছোট বাঁক বলে। পাকস্থলীর বামপাশ উত্তল এবং একে বড় বাঁক বলে। পাকস্থলীতে দুটি স্ফিংক্টার থাকে এবং এগুলো হলো কার্ডিয়াক স্ফিংক্টার ও পাইলোরিক স্ফিংক্টার।

খ) যান্ত্রিক পরিপাক : অন্ননালীপথে চর্বিত খাদ্য পাকস্থলীতে এসে ২ – ৬ ঘন্টা অবস্থান করে। এসময় পাকস্থলীর প্যারাইটাল কোষ থেকে HCl এসিড উৎপন্ন হয় যা খাদ্যকে জীবাণুমুক্ত করে। পাকস্থলীর পেশি অর্ধচূর্ণ খাদ্যকে পিষে পেস্ট এ পরিণত করে। এ সময় গ্যাস্ট্রিক জুস ক্ষরিত হয় যা খাদ্যের সাথে মিশে খাদ্যকে কাইম বা মন্ডে পরিণত করে।

গ) রাসায়নিক পরিপাক : পাকস্থলীতে শর্করা বিশ্লেষী কোনো এনজাইম না থাকায় এখানে শর্করা পরিপাক ঘটে না। গ্যাস্ট্রিক জুসে পেপসিনোজেন এবং প্রোরেনিন নামক দুটি নিষ্ক্রিয় এনজাইম থাকে। এগুলো HCl এসিডের সহায়তায় সক্রিয় পেপসিন ও রেনিনে রূপান্তরিত হয়। পেপসিনের উপস্থিতিতে আমিষ ও পানি প্রোটিওজ ও পেপটোনে পরিণত হয়। দুগ্ধ আমিষ কেসিন, রেনিন এনজাইমের উপস্থিতিতে প্যারাকেসিনে পরিণত হয় এবং প্যারাকেসিন পেপসিনের উপস্থিতিতে পেপটোনে পরিণত হয়। লিপিড বিশ্লেষী এনজাইম অম্লীয় পরিবেশে কাজ করতে পারে না বিধায় পাকস্থলীতে লিপিডের পরিপাক হয় না।

৩। ক্ষুদ্রান্ত্রে খাদ্য পরিপাক

ক) ক্ষুদ্রান্ত্রের গঠন : পাকস্থলী থেকে বৃহদন্ত্র পর্যন্ত যে লম্বা প্যাঁচানো তারের মতো অংশটি রয়েছে সেটিই ক্ষুদ্রান্ত্র। ক্ষুদ্রান্ত্র সাধারণত ৬-৭ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। এটি তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত। এরা হলো ডিওডেনাম, জেজুনাম ও ইলিয়াম। ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রথম অংশটি হলো ডিওডেনাম যা “U” আকৃতির। মাঝের অংশটি জেজুনাম যা আকারে সবচেয়ে বড় এবং শেষের অংশটি ইলিয়াম।

খ) যান্ত্রিক পরিপাক : আন্ত্রিক রসের সাহায্যে খাদ্যবস্তু পিচ্ছিল হয়। এ সময় ব্রুনার্স গ্রন্থি ও গবলেট কোষ থেকে ক্ষরিত মিউকাস ক্ষুদ্রান্ত্রের প্রাচীরকে এনজাইমের হাত থেকে রক্ষা করে। পিত্তরস পরোক্ষভাবে জীবাণুর কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কোলেসিস্টোকাইনিন পিত্তরসকে ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছাতে সাহায্য করে। পিত্তলবণ লিপিডকে সাবানের ফেনার মতো ক্ষুদ্র কণায় পরিণত করে। ক্ষুদ্রান্ত্রের পেশির ক্রমসংকোচন খাদ্যকে বৃহদন্ত্রের দিকে ধাবিত করে।

গ) রাসায়নিক পরিপাক : ক্ষুদ্রান্ত্রে সকল খাদ্যের চূড়ান্ত পরিপাক হয়ে থাকে। পিত্তরসে থাকা সোডিয়াম বাইকার্বোনেট খাদ্যকে ক্ষারীয় করে তোলে। শর্করা পরিপাকের ক্ষেত্রে এখানে স্টার্চ ও গ্লাইকোজেন, অ্যামাইলেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে মল্টোজে পরিণত হয়। সুক্রেজ এনজাইমের মাধ্যমে সুক্রোজ, গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজে পরিণত হয়। ল্যাক্টেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে ল্যাক্টোজ রূপান্তরিত হয় গ্লুকোজ ও গ্যালাক্টোজ এ। প্রোটিন পরিপাকের ক্ষেত্রে এখানে, ট্রিপসিন অথবা কাইমোট্রিপসিন এনজাইমের উপস্থিতিতে প্রোটিওজ ও পেপটোন রূপান্তরিত হয় পলিপেপটাইডে। লিপিড পরিপাকের ক্ষেত্রে এখানে, লাইপেজ এনজাইমের উপস্থিতিতে লিপিড ভেঙ্গে ফ্যাটি এসিড ও গ্লিসারলে পরিণত হয়।

আরও পড়ুন : মানব দেহে ম্যালেরিয়া পরজীবীর জীবনচক্র

খাদ্যবস্তুর শোষণ

খাদ্য সম্পূর্ণ পরিপাক হওয়ার পর চলে খাদ্যবস্তু শোষণের প্রক্রিয়া। ক্ষুদ্রান্ত্রের ইলিয়াম অংশে ও বৃহদন্ত্রে খাদ্যের শোষণ ঘটে থাকে। ইলিয়াম ও বৃহদন্ত্রের অন্তঃপ্রাচীরে অসংখ্য ভিলাই রয়েছে যার মাধ্যমে খাদ্যবস্তুর শোষণ ঘটে।

বৃহদন্ত্রের কাজ

  • ব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়া : বৃহদন্ত্রে বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া মিথোজীবী হিসেবে বাস করে যা আমাদের দেহের জন্য উপকারী।
  • শোষণ : ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে আগত পরিপাক বর্জ্যের পানির প্রায় ৭০-৮০% শোষিত হয় বৃহদন্ত্রে।
  • ক্ষরণ : বৃহদন্ত্রে থাকা গবলেট কোষ মিউকাস ক্ষরণ করে।
  • খাদ্যের অসার অংশ সঞ্চয় : ক্ষুদ্রান্ত্রে পরিপাক ও শোষণের পর খাদ্য ও পাচকরসগুলোর অবশিষ্ট উপাদান সিকাম ও কোলনে জমা থাকে।
  • মল উৎপাদন : খাদ্যের অপাচ্য অংশ ও পানি নিয়ে বৃহদন্ত্র দৈনিক মল উৎপাদন করে ও সাময়িক সময় জমা রাখে।

পায়ুর কাজ

বৃহদন্ত্রে উৎপন্ন হওয়া মল পায়ুর মাধ্যমে দেহের বাইরে নির্গত হয়। পায়ুতে অবস্থিত এনাল স্ফিংক্টার এটি নিয়ন্ত্রণ করে।

Reference

  • গাজী আজমল, গাজী আসমত, “জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র”, একাদশ – দ্বাদশ শ্রেণি, ৭ম সংস্করণ, গাজী পাবলিশার্স।
  • Human digestive system | Description, Parts, & Functions