Skip to content

মানব দেহে ম্যালেরিয়া পরজীবীর জীবনচক্র

ম্যালেরিয়া পরজীবী বা প্লাজমোডিয়াম পরজীবীর দুটি পোষক দেহ থাকে। অর্থাৎ এদের জীবনচক্র সম্পন্ন করতে দুটি আলাদা আলাদা প্রাণির দেহের প্রয়োজন হয়। এ দুটি পোষক হলো –
১। মশা
২। মানুষ

স্ত্রী এনোফিলিস মশার দেহে প্লাজমোডিয়াম জীবাণু যৌন জনন সম্পন্ন করে বিধায় মশাকে বলা হয় এ জীবাণুর নির্দিষ্ট পোষক এবং মানুষের দেহে এ জীবাণু অযৌন জনন সম্পন্ন করে বিধায় মানুষকে বলা হয় এ জীবাণুর মাধ্যমিক পোষক।

মানবদেহে ম্যালেরিয়া পরজীবীর জীবনচক্র

মানবদেহে এ জীবাণুর জীবনচক্র দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো-
১। হেপাটিক সাইজোগনি : যকৃতে সম্পন্ন হয়।
২। এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি : লোহিত রক্তকণিকায় সম্পন্ন হয়।

হেপাটিক সাইজোগনি

হেপাটিক সাইজোগনি বা যকৃত সাইজোগনি (যে চক্রটি যকৃতে সম্পন্ন হয়) কে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এরা হলো –
১। প্রি এরিথ্রোসাইটিক হেপাটিক সাইজোগনি
২। এক্সো এরিথ্রোসাইটিক হেপাটিক সাইজোগনি

প্রি-এরিথ্রোসাইটিক হেপাটিক সাইজোগনি

এ চক্রের ধাপগুলো হলো-

১। স্ত্রী এনোফিলিস মশার লালাগ্রন্থীতে প্লাজমোডিয়াম পরজীবীর স্পোরোজয়েট দশাটি অবস্থান করে। মশাটি যখন কোনো মানুষকে কামড়ায় তখন মশার লালার মাধ্যমে স্পোরোজয়েটটি মানুষের দেহে প্রবেশ করে।

২। মানুষের দেহে প্রবেশ করার পর স্পোরোজয়েট যকৃতের প্যারেনকাইমা কোষের ভিতর প্রবেশ করে।

৩। স্পোরোজয়েটগুলো হলো মাকু আকৃতির। যকৃতে প্রবেশ করার পর এরা যকৃত থেকে খাদ্য গ্রহণ করে গোলাকার ক্রিপ্টোজয়েটে পরিণত হয়।

৪। এরপর গোলাকার ক্রিপ্টোজয়েটগুলোর ভিতরের নিউক্লিয়াসটি বিভাজিত হতে থাকে এবং বহু নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়।

৫। বহু নিউক্লিয়াসযুক্ত পরজীবীর এ দশাকে সাইজন্ট বলা হয়।

৬। একটি সাইজন্টের ভিতর বহু নিউক্লিয়াস থাকে। নিউক্লিয়াসগুলোর চারপাশে কিছু পরিমাণে সাইটোপ্লাজম ও প্লাজমামেমব্রেন সৃষ্টি হয়। পরজীবীর এ দশাকে ক্রিপ্টোমেরোজয়েট বলে।

৭। তারপর পরজীবীর বাইরের আবরণটি ভেঙ্গে যায় এবং ভিতরের অসংখ্য ক্রিপ্টোমেরোজয়েট গুলো স্বাধীনভাবে বাইরে বেরিয়ে আসে।

 

হেপাটিক-সাইজোগনি
হেপাটিক সাইজোগনি

এক্সো-এরিথ্রোসাইটিক হেপাটিক সাইজোগনি

এ চক্রের ধাপগুলো হলো –
১। প্রি-এরিথ্রোসাইটিক হেপাটিক সাইজোগনি চক্র থেকে উৎপন্ন ক্রিপ্টোমেরোজয়েটগুলো নতুন আরেকটি সুস্থ যকৃত কোষকে আক্রমণ করে।

২। নতুন যকৃত কোষে প্রবেশ করার পর এদের নিউক্লিয়াস বিভাজিত হতে থাকে এবং বহু নিউক্লিয়াসযুক্ত দশায় পরিণত হয়। পরজীবীর এ দশাকে সাইজন্ট বলে।

৩। সাইজন্টের প্রতিটি নিউক্লিয়াসের পাশে সাইটোপ্লাজম ও প্লাজমামেমব্রেন জমা হয়ে নতুন কোষ সৃষ্টি করে। পরজীবীর এ দশাকে মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট বলে।

৪। এরপর পরজীবীর বাইরের আবরণটি ভেঙ্গে যায় এবং মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট গুলো স্বাধীনভাবে বাইরে বেরিয়ে আসে। এর মাধ্যমে এক্সো-এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি চক্রের সমাপ্তি ঘটে।
এক্সো-এরিথ্রোসাইটিক হেপাটিক সাইজোগনি থেকে উৎপন্ন মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট গুলো সাধারণত দুই প্রকারের হয়। আকারের ভিত্তিতে এদের দুভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো:-
১। মাইক্রো মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট : আকারে ছোট।
২। ম্যাক্রো মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট : আকারে বড়।

ম্যাক্রো মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট গুলো অর্থাৎ বড় মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট গুলো পুনরায় নতুন যকৃত কোষকে আক্রমণ করে অর্থাৎ হেপাটিক সাইজোগনি চক্র চালাতে থাকে। অপরদিকে মাইক্রো মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট গুলো অর্থাৎ আকারে ছোট মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট গুলো লোহিত রক্তকণিকাকে আক্রমণের মাধ্যমে এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি চক্রে প্রবেশ করে।

আরও পড়ুন : ম্যালেরিয়া জ্বরের লক্ষণ, প্রতিকার, ওষুধ ও টিকা

এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি

লোহিত রক্তকণিকায় প্লাজমোডিয়াম পরজীবীর যে জীবনচক্র সম্পন্ন হয় তাই এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি। এ চক্রের ধাপগুলো হলো :-

১। মাইক্রো মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট গুলো লোহিত রক্তকণিকায় প্রবেশ করে খাদ্য গ্রহণ করতে থাকে এবং স্ফীত ও গোলাকার হয়ে উঠে। পরজীবীর এ দশাকে ট্রফোজয়েট দশা বলে।

২। ট্রফোজয়েট দশার ভিতরে একটি কোষ গহ্বর থাকে। কোষ গহ্বরটি ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। পরজীবীর এ দশাকে ‘সিগনেট রিং‘ বলে। কেননা কোষ গহ্বরটি বড় হওয়ার কারনে এ দশাটিকে দেখতে অনেকটা আংটির মতো দেখায়।

এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি
এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি

 

৩। এরপর জীবাণুটি অ্যামিবার মতো ক্ষণপদবিশিষ্ট আকৃতির হয় এবং এ দশাকে অ্যামিবয়েড ট্রফোজয়েট বলে। এ সময় লোহিত রক্ত কণিকার সাইটোপ্লাজমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানা দেখা যায়। এ দানাগুলোকে সাফনার্স দানা বলা হয়।

৪। অ্যামিবয়েড ট্রফোজয়েট দশার নিউক্লিয়াসটি বারবার বিভাজিত হয়ে বহু নিউক্লিয়াসযুক্ত দশায় পরিণত হয়। পরজীবীর এ দশাকে সাইজন্ট বলে।

৫। সাইজন্টের প্রতিটি নিউক্লিয়াসের পাশে সাইটোপ্লাজম ও প্লাজমামেমব্রেন জমা হতে থাকে। এ সময় জীবাণুগুলোকে দেখতে গোলাপের পাপড়ির ন্যায় দেখায়। তাই এ দশাকে রোজেট বলা হয়।

৬। পরবর্তীতে লোহিত রক্তকণিকাটি ভেঙ্গে যায় এবং মেরোজয়েটগুলো বাইরে বেরিয়ে আসে এবং নতুন লোহিত রক্তকণিকাকে আক্রমণ করে।

৭। কিছু মেরোজয়েট গ্যামিটোসাইটে পরিণত হয়। গ্যামিটোসাইট দুই ধরনের হয়ে থাকে। ছোট গ্যামিটোসাইটগুলোকে বলা হয় পুং গ্যামিটোসাইট এবং বড় গ্যামিটোসাইট গুলোকে বলা হয় স্ত্রী গ্যামিটোসাইট। পুং ও স্ত্রী গ্যামিটোসাইটগুলো মানবদেহের প্রান্তীয় রক্তনালীগুলোতে অবস্থান করে এবং মশার কামড়ের মাধ্যমে এরা মশার দেহে প্রবেশ করে এবং মশার দেহে ম্যালেরিয়া জীবাণুর জীবনচক্র সম্পন্ন করে।

Frequently Asked Questions (FAQs)

প্রশ্ন : ম্যালেরিয়া পরজীবীর কয়টি পোষক দেহ থাকে ও কী কী?
উত্তর : ২টি। মশা ও মানুষ।

প্রশ্ন : ম্যালেরিয়া পরজীবীর নির্দিষ্ট পোষক কোনটি?
উত্তর : মশা।

প্রশ্ন : ম্যালেরিয়া পরজীবীর মাধ্যমিক পোষক কোনটি?
উত্তর : মানুষ।

প্রশ্ন : যকৃতে ম্যালেরিয়া পরজীবীর কোন চক্র সম্পন্ন হয়?
উত্তর : হেপাটিক সাইজোগনি।

প্রশ্ন : লোহিত রক্তকণিকায় ম্যালেরিয়া পরজীবীর কোন চক্র সম্পন্ন হয়?
উত্তর : এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি।

প্রশ্ন : ম্যালেরিয়া পরজীবীর কোন দশাটি মশা থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে?
উত্তর : স্পোরোজয়েট।

প্রশ্ন : ম্যালেরিয়া পরজীবীর কোন দশাটি এক্সো-এরিথ্রোসাইটিক হেপাটিক সাইজোগনি চক্রটি শুরু করে?
উত্তর : ক্রিপ্টোমেরোজয়েট।

প্রশ্ন : ম্যালেরিয়া পরজীবীর কোন দশাটি এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি চক্রটি শুরু করে?
উত্তর : মাইক্রো মেটাক্রিপ্টোমেরোজয়েট।

প্রশ্ন : সাইজন্ট কী?
উত্তর : বহু নিউক্লিয়াসযুক্ত প্লাজমোডিয়াম পরজীবীর দশাই সাইজন্ট।

প্রশ্ন : হিমোজয়েন কী এবং কখন দেখা যায়?
উত্তর : এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি চক্রের সাইজন্ট দশায় সাইজন্টের ভিতর হিমোজয়েন দেখা যায়। এগুলো পরজীবীর বর্জ্য পদার্থ।

প্রশ্ন : পাইরোজেন কী এবং কখন দেখা যায়?
উত্তর : এরিথ্রোসাইটিক সাইজোগনি চক্রের শেষে মেরোজয়েটগুলো যখন রক্তস্রোতে মিশে যায় তখন শ্বেত রক্তকণিকাগুলো এদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। এ সময় রক্তে পাইরোজেন নামক রাসায়নিক পদার্থ দেখা যায়। এর প্রভাবেই শরীরে জ্বর আসে।

আরও পড়ুন : হেপাটাইটিস বি এর লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায়

Reference

  • ড. মোহাম্মদ আবুল হাসান, “জীববিজ্ঞান প্রথম পত্র”, একাদশ – দ্বাদশ শ্রেণি, ৪র্থ সংস্করণ, হাসান বুক হাউস।
  • CDC – Malaria
  • Malaria parasite life cycle